jahar Bhanu

সেই ব্র্যাকেটটা ভেঙে গেল

একই পেশায় যুক্ত বাবার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু ‘জহর কাকা’ । আপনাদের জহর রায়। ৭৭ সালে জহর কাকার মৃত্যুর পরে স্মৃতিচারণায় বাবা যা বলেছিলেন, তা-ই আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। নিজস্ব সংগ্রহ থেকে এই উপহার দিচ্ছেন বাসবী বন্দ্যোপাধ্যায় ঘটক…

একত্রিশ বছরের সেই ব্র্যাকেটটা ভেঙে গেল।আর কোনোদিন জোড়া লাগবে না। সকালবেলায় জহর নেই শুনে আমার এরকমই মনে হল। চিরকাল পাশাপাশি এক নিঃশ্বাসে লোকে আমাদের নাম উচ্চারণ করে এসেছে। জহর থাকলেই ভানু থাকবে, ভানু থাকলেই জহর। কিন্তু আমি এখনও যেন বিশ্বাস করতে পারছি না, জহর নেই, কিন্তু ভানু আছে।

আর এই যে বন্ধন, বন্ধুত্ব, আত্মীয়তা ভানু জহরের মধ্যে সে কী একদিনের? সে কি আজকের? মনে পড়ে… কত কী মনে পড়ে… কত কথা মনে পড়ে। স্মৃতি, স্মৃতি, স্মৃতি–! স্মৃতির চিত্রশালা।

জহরের সঙ্গে প্রথম আলাপ পরিচালক সুশীল মজুমদারের বাড়ি । সেই বিশাল চেহারার অধিকারী ছেলেটিকে দেখে সেদিন বুঝতেই পারিনি, ওরই সঙ্গে আমার ভাগ্যের গাঁটছড়া এমন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে যাবে।

ছেলে বললুম এই জন্য যে, জহর তখন ছেলেই। বছর ২৭ বয়স হবে। আমারও তাই ।সেটা ‘৪৭-এর কথা। সেই শুরু। আর আজ ‘৭৭। মাঝখানে তিরিশটা বছর পার হয়ে গেল। তিরিশ বছরের স্মৃতির অ্যালবাম খুলে পাতার পর পাতা উল্টে যাই। কত দুঃখ, কত সুখ, কত ভয়, কত পরাজয়, দুজনের এক সঙ্গে।

মনে পড়ছে খোকার কথা। খোকা, যে ছেলেটি স্টুডিয়োয় আর্টিস্টদের খাবারের ব্যবস্থা করে । শুটিং শুরু হবার সময়ে আর্টিস্টরা কে কি খাবেন, তা নোট করে, তা পরিবেশন করাই তার কাজ‌। কিন্তু আমাদের কাছে, মানে আমার বা জহরের কাছে কোনোদিন সে, আমরা কী খাব জিজ্ঞেস করত না। কেননা তা জানাই ছিল, আর্টিস্টদের জন্য যতরকম খাবার রান্না হবে, তার সবগুলোই আমাদের চেখে দেখা চাই।আমাদের ফুড হ্যাবিটের এত মিল ছিল।‌ কিন্তু সেই খোকার হাতে জহরের জন্য কোন প্লেট থাকবে না।

জহর ও আমার মধ্যে কোন প্রোফেশনাল জেলাসি ছিল না। হয়তো অনেকের খটকা লাগবে, কিন্তু সত্যি, একথা হান্ড্রেড পারসেন্ট সত্যি। একবার, সেটা ১৯৫৮, আমার একটা যাত্রার শো ছিল মেদিনীপুরে। তা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমার যাওয়া ক্যানসেল করতে হল।

উপায়ান্তর না দেখে জহরকে টেলিফোনে বললুম, এ যাত্রা বাঁচিয়ে দে। সঙ্গে সঙ্গে রাজি। জামা কাপড় পরে হাজির।

প্রথম প্রথম লোকে আমাদের বলতে ‘লরেল হার্ডি’। আমি ‘লরেল’ আর ও ‘হার্ডি’।

এই ইমেজ কাটাতে আমাদের কনশাসলি অনেক খাটতে হয়েছে। পরে যখন জহর রোগা হয়ে গেল, তখন একবার একটা জলসায় বলেছিল, রোগা হয়ে যাওয়াটা কোনো অসুখ নয়, ওটা একটা ‘কন্ট্রাকচুয়াল’ ব্যাপার। কেননা আমি তখন মোটা হচ্ছি। আর আমাদের মধ্যে কথাই ছিল, আমি যখন মোটা হবো, তখন ও রোগা হবে।

হ্যাঁ , একটা কথা। ওর অভিনয়ের একটা দিককে আমি শ্রদ্ধা করি। ওর কায়িক অভিনয়। কী অসম্ভব ফিজিক্যাল ফিটনেস। ‘উল্কা’ নাটকের একটা দৃশ্য…তুপের চরিত্রে অভিনয় করছে জহর। একটা ঘুঁষি খেয়ে পড়ে যাওয়ার দৃশ্য ছিল জহরের। পাখির মতো উড়ে গিয়ে স্টেজে পড়ত। ক’জন এই জিনিস পারবেন জানি না। অন্তত আমি তো পারব না।

আমি মনে করি, বাংলাদেশের দর্শক–শ্রোতারা কোনোদিন জহর রায়কে ভুলতে পারবেন না। কেননা, ওর ৫৭ বছরের এই জীবনে, বাংলার মানুষকে জহর অঢেল উপহার দিয়েছে। দিয়েছে আড়াইশোরও বেশি ছবিতে আর মঞ্চে অভিনয়ে। রেজিয়ার নাটকে তাঁর কণ্ঠস্বর এখনও জীবন্ত। এইসঙ্গে আমাদের আরো মনে পড়ে যাবে গ্রামোফোন ডিসক আর জলসায় জহরের কৌতুক অভিনয়।

জহর আজ আর নেই। অথচ আমি পড়ে আছি। বন্ধু, অভিভাবক, সহশিল্পী, সহযোদ্ধা— জহরের আত্মার চিরশান্তির জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছি।

নাকি, এটাও জহরের রসিকতা– যেমন বরাবর পড়ে এসেছে আমার সঙ্গে। জহরহীন ভানু ব্যানার্জিকে আবার রং কালি মেঘের স্টুডিওর জোরালো আলোর সামনে দাঁড়িয়ে দর্শকদের হাসাতে হবে? বলুন না, সে জুটির একজনকে দেখতে না পেয়েও আপনার কি আবার আগের মতই হাসবেন? হাসতে পারবেন?